বাংলাদেশের নতুন শ্রমবাজার : ইউরোপ

 

গত ৩ এপ্রিল গণভবনে অনুষ্ঠিত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সংক্রান্ত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের চুম্বক অংশটি দেশের সব পত্রিকায় খুবই গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত দূরদর্শী ও সময়োপযোগী এ বক্তব্যে বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য জনশক্তিকে দক্ষতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এজন্য কূটনীতিকে এখন রাজনৈতিক বলয় থেকে বিস্তৃত করে অর্থনৈতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

দেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরাও বহুদিন আগে থেকেই নতুন নতুন শ্রমবাজার খুঁজে সেখানে জনশক্তি রপ্তানি করে বেসরকারি পর্যায়ে তাদের ভূমিকা রেখে চলেছেন। এসব নতুন দেশের অনেকগুলোই ইউরোপ মহাদেশের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী দেশ।

একজন পর্যটন ব্যবসায়ী হয়েও একই সঙ্গে বাংলাদেশের একটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বৈদেশিক প্রতিনিধি হিসেবে আমি নিজেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে পর্যটন ব্যবসার পাশাপাশি বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির জন্য ইউরোপের দেশগুলোতে নতুন বাজারের সন্ধানে গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে একুশ দিনের এক দীর্ঘ ব্যবসায়িক সফরে রোমানিয়া, সার্বিয়া, অস্ট্রিয়া, ইতালি ও পোল্যান্ড ভ্রমণ করেছি এবং এসব দেশের বিভিন্ন চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত অনেকগুলো বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছি। এসব বৈঠকে চাকরিদাতা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনায় যা উঠে এসেছে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হচ্ছে সেসব দেশে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা, যা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে গুরুত্বপূর্ণভাবে বিবৃত হয়েছে।

বিভিন্ন বাস্তবিক কারণেই ইউরোপের দেশগুলোতে ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে দক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা। বিভিন্ন ধরনের হালকা ও ভারি নির্মাণশিল্পের শ্রমিক, বিভিন্ন রকমের কারখানা ও ওয়্যারহাউসের শ্রমিক, রেস্টুরেন্টের শেফ ও ওয়েটার, ভারি যানবাহনের ড্রাইভারসহ বিভিন্ন পেশায় দক্ষ কর্মীদের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে দক্ষ ওয়েল্ডার ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের চাহিদা। এদের চাহিদা যেমন বেশি, তেমনি বেতনও তুলনামূলকভাবে অনেক। পক্ষান্তরে অদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা যেমন কম, তাদের বেতনও অনেক কম।

তাই আমাদের বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিকদের বর্তমান চাকরি বাজারের উপযুক্ত করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আমরা যদি বিভিন্ন পেশায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের শ্রমিকদের বিদেশে প্রেরণ করতে চাই, তাহলে ইউরোপের দেশগুলো হতে পারে আমাদের জন্য চমৎকার এক শ্রমবাজার। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় ইউরোপের এসব দেশে বেতনের পরিমাণও কয়েকগুণ বেশি এবং সুযোগ-সুবিধাও অনেক। তাছাড়া বিশ্বের উন্নত দেশ হওয়ার কারণে এসব দেশের জীবনযাপনের মানও অনেক উন্নত এবং বেশিরভাগ দেশেই পাঁচ বছর নিয়মমাফিক অবস্থান করলে শর্তসাপেক্ষে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়া যায়।

একটি বাস্তবিক ব্যাপার হলো যে, আমাদের দেশের শ্রমিকদের মধ্যে যাদের ওইসব দেশে স্থায়ী বসবাসের ইচ্ছে রয়েছে, স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন তাদের জন্য বয়ে আনতে পারে তাদের নিজেদের জীবনমান পরিবর্তনের এক সুবর্ণ সুযোগ। আর এসব দেশে অবস্থান করে চাকরির মাধ্যমে অর্থোপার্জন করে তা দেশে পাঠানোর মাধ্যমে তারা তাদের পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে যেমন ভূমিকা রাখতে পারে; তেমনি তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনীতিতে আনতে পারে এক সোনালি বিপ্লব, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক উন্নয়নে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
তবে ইউরোপে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বিপুল এই সম্ভাবনার হাত ধরে একই সঙ্গে চলে এসেছে একটি মারাত্মক বাস্তবিক আশঙ্কাও; যা এই সম্ভাবনাকে হয়তো বা আঁতুড়ঘরেই হত্যা করতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

ইউরোপের দেশগুলোতে শ্রমিকদের অভিবাসনের পছন্দের তালিকায় বর্তমানে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশ রোমানিয়া; যে দেশটি প্রায় তিন দশক আগে কমিউনিজম শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং বর্তমানে শেঙ্গেন দেশগুলোর জোটে অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এই দেশটিতে অভিবাসনের প্রত্যাশায় এত বেশি ভিসার আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যে, রোমানিয়া সরকার এসব আবেদন নিষ্পত্তি করে ভিসা প্রদানের জন্য গত বছর তিন মাসের মেয়াদে একটি কনস্যুলার টিম বাংলাদেশে প্রেরণ করেছিলেন এবং বর্তমান বছরের মার্চ মাস থেকে আবারো তারা ঢাকায় এই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এটি আমাদের জনশক্তি রপ্তানির জন্য একটি দারুণ ইতিবাচক ব্যাপার।

কিন্তু আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা যে আশঙ্কার উদ্রেক করেছে তা অত্যন্ত বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক এবং তা সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকলের ভেবে দেখার দাবি রাখে বৈকি!
রোমানিয়াসহ উল্লেখিত দেশগুলোর প্রায় সবটিতেই অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে একজন শ্রমিককে তাদের দেশে এনে কাজে যোগদান করাতে একজন চাকরিদাতাকে কমবেশি প্রায় ৬ মাস সময় অপেক্ষা করতে হয়। এর জন্য তাদের অর্থকড়িও খরচ করতে হয়। কিন্তু এত অপেক্ষার পর চাকরিদাতারা যেসব শ্রমিককে তাদের দেশে নিয়ে আসেন, তারা কিছুদিন চাকরি করার পর; এমনকি কখনো কখনো সেসব দেশে পদার্পণের পরপরই আরো উন্নত জীবন পাওয়ার আকাক্সক্ষায় তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যান ফ্রান্স, ইতালি কিংবা ইউরোপের অন্যান্য উন্নত দেশে সেখানে অবস্থান করা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে; যা একজন চাকরিদাতার জন্য এক চরম ক্ষতিকর ব্যাপার। এই ক্ষতি শুধু যে চাকরিদাতার জন্য ক্ষতি তা নয়; এই ক্ষতি পালিয়ে যাওয়া এসব বাংলাদেশি শ্রমিকেরও।

কারণ অবৈধভাবে ভিন্ন দেশে অনুপ্রবেশের কারণে তারা সেসব দেশেও হয়ে পড়েন অবৈধ অভিবাসী এবং তাদের ভবিষ্যৎকে করে তোলেন ঝুঁকিপূর্ণ। যখন তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন, তখন আর সেখানে ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। তারা সেসব দেশে যাপন করেন অবর্ণনীয় এক দুঃস্বপ্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত জীবন, যা তাদের পরিবারের কাছে তারা লজ্জায় প্রকাশ করেন না; আর আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ তাই তা জানতেও পারেন না।

অপরদিকে এসব পালিয়ে যাওয়া শ্রমিকের কারণে ওইসব দেশের চাকরিদাতাও বাংলাদেশের শ্রমিকদের চাকরি প্রদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এর ফলে যেসব শ্রমিক ওইসব দেশে অভিবাসনের প্রত্যাশায় দিন গুনছেন, তাদের জন্য সেই সুযোগ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে; বিনা দোষে কপাল পুড়ছে তাদের। অথচ ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার শ্রমিকরা কিন্তু তাদের চাকরির শর্ত ভঙ্গ করছেন না এবং সুনামের সঙ্গেই তারা ওইসব দেশে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের শ্রমিকরা যদি এমন অপরিণামদর্শী না হতেন; তাদের চাকরিদাতাকে বিপদে না ফেলে সেখানেই চাকরি করতেন তবে সেসব দেশে আমরা লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতাম।

আরেকটি ব্যাপারে সদাশয় সরকারের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে আজকের মতো ইতি টানতে চাই। গত ৬ মার্চ তুষার ঢাকা এক হিমশীতল বিকালে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশোতে পোলিশ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিনিধিসহ আমি বাংলাদেশ দূতাবাসের মান্যবর রাষ্ট্রদূতের উষ্ণ আতিথেয়তায় দূতাবাসের অফিসে এক ঘণ্টা স্থায়ী এক বৈঠকে অংশগ্রহণ করি। জনশক্তি রপ্তানির ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মান্যবর রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের দুজনের ব্যাপক আলোচনা হয় এবং তিনি বাংলাদেশের শ্রমিকদের চাকরির সুযোগ খোঁজার জন্য আমাকে ধন্যবাদ প্রদান করেন তবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটি অংশ ভিন্ন দেশে চলে যাওয়ার ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দক্ষ শ্রমিকদের চাকরির চাহিদার ব্যাপারে তিনিও একমত প্রকাশ করেন এবং আমি তাকে জানাই যে, বৈঠকে উপস্থিত পোলিশ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি আমার কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ ওয়েল্ডার এবং কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের (সফটওয়ার ও হার্ডওয়ার) কর্মসংস্থানের জন্য আমাকে একটি চাহিদাপত্র প্রদান করেছেন এবং আমি এই কোম্পানির সব কাগজপত্র এবং উক্ত ওয়েল্ডার ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মস্থল, কর্মপরিবেশ এবং থাকার জায়গা ইত্যাদি দূতাবাসের মাধ্যমে পরীক্ষা, পরিদর্শন ও সত্যায়িত করাতে চাইলে তিনি তার জনবলের অপ্রতুলতার কথা প্রকাশ করলেও তিনি ব্যাপারটি দেখবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করেন।

এখানে বলা উচিত যে, পোল্যান্ডে প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি নাগরিকের বসবাস এবং আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, এখানে বাংলাদেশিদের মালিকানায় বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের সংখ্যা বর্তমানে এক হাজারেরও বেশি! আমার মনে হয়েছে সুন্দর এই দেশটি বাংলাদেশিদের জন্য একটি উদ্যোক্তার দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে পোল্যান্ড এবং জার্মানি হতে পারে আমাদের একটি প্রধান শ্রমবাজার কেননা জার্মানিও ইতোমধ্যে তাদের প্রায় ৬০ হাজার দক্ষ জনশক্তির চাহিদার ঘোষণা দিয়েছে।

সদাশয় সরকার পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসে জনবল বৃদ্ধি ও লেবার কাউন্সিলর নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারটি বিবেচনায় নিলে সেখানে আমাদের জনশক্তি রপ্তানির কাজটি সহজ হতে পারে। আর বাংলাদেশে যেহেতু পোল্যান্ডের কোনো দূতাবাস নেই, তাই আমাদের নাগরিকদের ভিসার আবেদনপত্র জমা দিতে যেতে হয় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এবং সেখানে প্রায় এক মাস অবস্থান করতে হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মতো পোল্যান্ডের ভিসা আবেদনপত্রও যদি ‘ভিএফএসে’র (ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সেন্টার) মাধ্যমে ঢাকায় জমা নেয়ার ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে আমাদের নাগরিকদের ভিসা আবেদনের খরচ কমে যেত অনেক এবং তাদের মূল্যবান সময় বেঁচে যেত। আশা করি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি পোলিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানি সহজীকরণে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করবেন।

ড. মো. মামুন আশরাফী : লেখক : কবি, রাষ্ট্রচিন্তক ও পর্যটন বিশেষজ্ঞ।

     More News Of This Category

https://www.facebook.com/bm24tvofficialpage