“ইসলামের ইতিহাসে গাদীরে খুম্মের গুরুত্ব”—-মুফতী মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী আরবী ১৮ জিলহজ্ব ১০ম হিজরী বৃহস্পতিবার ৬৩২ ঈসায়ী ইসলামি ইতিহাসের একটি স্মরণীয় ঐতিহাসিক দিন। জিলহজ্বের এ দিনটি “গাদীর খুম” দিবস নামে পরিচিত। দশম হিজরীর এ দিনে রাসুলে কারীম রাউফুর রাহীম সাঃ যে ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন সেই আলোকে মুসলিম উম্মাহ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দিনটি উদযাপন করে থাকে। আল্লাহর রাসুল সাঃ এটা জানতেন যে প্রত্যাদেশ বাণী বা আল্লাহ প্রদত্ত মানবের জীবন বিধান পূর্ণতা লাভ করার পর তিনি বেশি দিন ইহজগতে থাকবেন না। তাই নবম হিজরীর পর থেকেই মূলত তিনি এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু করেছিলেন। ঐ সময় ইসলামের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধা- দ্বন্দ ও সংশয় সৃষ্টির জন্যে কাফের মুশরেকদের পক্ষ থেকেও জোর তৎপরতা শুরু হয়েছিল। তারা প্রচার করতো ইসলামের নবীর কোন পুত্র সন্তান নেই , কাজেই তার মৃত্যু হলে ইসলাম ধর্মের অস্তিত্বও আস্তে আস্তে বিলিন হয়ে পড়েবে। এমন এক অবস্থায় মুসলমানদের মনে কিছুটা অস্বস্তি বিরাজ করছিল।
সাহাবায়ে কেরাম রাঃ এটা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করতেন ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত মানব জীবন বিধান । এটা চিরস্থায়ী এবং পূর্ণাঙ্গ। পবিত্র কোরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্যে সর্বশেষ ঐশি শ্বাশত গ্রন্থ এবং হযরত মুহাম্মদ সাঃ হচ্ছেন সর্বশেষ নবী এবং রাসুল। কাজেই দ্বীন ইসলাম চিরকাল টিকে থাকবে । ইসলামের বিধান শ্বাশত, অমর ও অক্ষয়। যতদিন এ জগত থাকবে ইসলামের দেদীপ্যমান দ্বীপ্তি আলো বিকিরণ করে যাবে। এ আলো নিভিয়ে দেয়ার ক্ষমতা কোন শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। জাজ্বল্যমান এই বিশ্বাসকে ধারণ করার পরও মুসলমানদের মনে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। আল্লাহর রাসুলের ইহলোক ত্যাগের সম্ভাবনায় একদিকে তাদের মনে ছিল বিরহজনিত অন্তর্দাহ।
অন্যদিকে ইহুদী, খৃষ্টান ও পৌত্তলিকদের অব্যাহত চক্রান্তের কথা ভেবে তারা ইসলামের ভবিষ্যতের ব্যাপারেও নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন । সবার কাছে এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল, প্রিয় নবীজী যখন এ জগতে থাকবেন না, তখন পবিত্র কোরআনকে ব্যাখ্যা করবেন, মুসলমানরাই বা জীবন জিজ্ঞাসার জবাব জানার জন্যে কার দ্বারস্থ হবেন?
ইতোমধ্যে হজ্বের সময় ঘনিয়ে এল। রাসুলে কারীম সাঃ মুসলমানদেরকে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র হজ্ব পালন করলেন। এটাই ছিল আল্লাহর রাসুলের শেষ হজ্ব । বিদায় হজ্ব নামে যা আজও পরিচিত। হজ্বের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে নবীজী এবার লক্ষ মুসলমানদের কাফেলাকে সঙ্গে নিয়ে মাতৃভূমি মক্কাকে বিদায় জানালেন, চলছেন প্রিয় মদিনার পথে। আল্লাহর রাসূলকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছিল, এটা বিশিষ্ট সকল সাহাবিই লক্ষ্য করলেন। সবার মনেই এক অজানা আশঙ্কা। এমন সময় কাফেলা গাদীরে খুম নামক এক স্থানে এসে পৌঁছায় ।
ছোট্ট জলাশয় বা ডোবাকে আরবীতে গাদীর বলা হয়। গাদীরে খুম নামক স্থানটি মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি হেজাজের রাগিবের নিকটবর্তী জুহফার মসজিদের পার্শ্ববর্তীতে অবস্থিত । মরু আরবের মুসাফির বা বাণিজ্য কাফেলাগুলো সাধারণত এই ছোট্ট জলাশয়ের পাশে সাময়িক বিশ্রামের জন্যে অবস্থান করতো । আল্লাহর রাসুল যখন এই স্থানে এসে পৌঁছলেন তখন হযরত জিব্রাইল (আ) সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াত নিয়ে হাজির হলেন । বলা হলো- “হে রাসুল ! তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা তুমি সবার কাছে পৌঁছে দাও , যদি তা না কর তাহলে তো তুমি তার বার্তা প্রচার করলে না । ”
রাসুলে রাব্বুল আ’লামীন সাঃ আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার পর তিনি সবাইকে গাদীরে খুম নামক স্থানে সমবেত হতে বললেন। যারা কিছুটা এগিয়ে ছিলেন তারা পিছনে ফিরলেন। আর যারা পিছনে ছিলেন তারা এগিয়ে এলেন। রৌদ্রস্নাত উত্তপ্ত মরু হাওয়ায় সবাই ক্লান্ত অবসন্ন । তারপরও সকলেই প্রবল মনোযোগ সহকারে অপেক্ষা করতে লাগলেন আল্লাহর রাসুল কি বলবেন তা শুনার জন্য। আল্লাহর রাসুল উটের জিনকে মঞ্চের মত করে তাতে আরোহণ করলেন। এরপর সমবেত সকলকে লক্ষ করে বললেন, ”হে মুসলিমগণ! অচিরেই আমার জীবনের অবসান ঘটবে, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এ জগত থেকে চলে যেতে হবে আমাকে। আমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল ।
আমি কি আমার উপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি? সকলেই সমস্বরে বলে উঠল, হে আল্লাহ নবী ও রাসূল ! আপনি আপনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন এবং এ পথে আপনি অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছেন। এরপর আল্লাহর রাসুল সাঃ চারদিকে তাকিয়ে হযরত আলীর দুই হাত উত্তোলন করে বললেন, মহান আল্লাহ হচ্ছে আমার অলী এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী। আমি হচ্ছি মুমিন বিশ্বাসীদের অলী ও অভিভাবক, আর আমি যার নেতা ও অভিভাবক, আলীও তার নেতা ও অভিভাবক। হে আল্লাহ! যে আলীকে বন্ধু মনে করে তুমি তাকে দয়া ও অনুগ্রহ করো, আর যে আলীর সাথে শত্রুতা করে, তুমি তার প্রতি একই মনোভাব পোষণ করো । রাসু্লে সাঃ এর এই ভাষণের পরপরই হযরত জিব্রাইল (আ.) আবার অহী বা প্রত্যাদেশ বাণী নিয়ে এলেন। বলা হলো “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন বা জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম ।
( সুরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াত ) গাদীরে খুমের ঐতিহাসিক ঘোষণায় আল্লাহর রাসুল কার্যত হযরত আলীকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবেই নিযুক্ত করেছিলেন । তাই আমরা লক্ষ্য করি তাবুক অভিযানের সময় নবী করিম সাঃ এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু নবীজী হযরত আলীকে মদিনায় থেকে যেতে বললেন। হযরত আলী রাঃ এর কারণ জানতে চাইলে আল্লাহর রাসূল উত্তরে বলেছিলেন, ”তুমি কি চাও না মুসার স্থলে হারুন যেমন ছিল, তেমনি আমার স্থলেও হোক তোমার স্থান। যদিও আমার পরে আর কোন নবী বা রাসুল আসবে না। রাসুলে খোদা সাঃ এর অসংখ্য উক্তি বা বক্তব্যের আলোকে মুসলিমদের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করেন, মহানবী সাঃ এর পর মুসলিমদের নেতৃত্ব বা পবিত্র কোরআনের যথার্থ ব্যাখ্যার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল হযরত আলী রাঃ এর উপর। তিনি মুসলিমদের ইমাম হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন, আর এই দায়িত্ব চূড়ান্তভাবে অর্পিত হয়েছিল গাদিরে খুমের ঐতিহাসিক স্থানে।
ইসলাম নবী করিম সাঃ এর সাহাবাদের স্থান ও মর্যাদা অত্যন্ত উঁচুতে। সত্য ও ন্যায়ের ঝাণ্ডাবাহী সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় ইসলাম আদর্শ জীবন বিধান হিসেবে পৃথিবীজুড়ে বিকশিত ও প্রসারিত হয়েছিল। নূরনবীর সাহাবীগণ উত্তম চরিত্র, উন্নত ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ত্যাগের যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তার দ্বিতীয় উদাহরণ মানব ইতিহাসে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। তাই সত্যকামী নবীজীর প্রত্যেক সাহাবীই ইসলামের ইতিহাসের এক একটি নক্ষত্র। অগণিত নক্ষত্রের একজন হয়েও সন্ধ্যা তারা যেমন সূর্যের বর্ণচ্ছটায় উজ্জল, হযরত আলী রাঃ তেমনি বিশ্বনবীর নৈকট্য মহিমায় ইমামতের দ্বীপ্তিতে উজ্জ্বল। দিবসের দ্বীপ্ত রবি অস্তমিত হওয়ার পর ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে প্রশান্তির বাণী নিয়ে যেমনিভাবে গগণ কোণে সন্ধ্যা তারার উদয় হয়। বিশ্বনবীর অন্তর্ধানের পর আলোকবর্তিকা হিসেবে দিগভ্রান্ত ইসলামের গগণ কোণে দেখা দিলেন হযরত আলী রাঃ।
হযরত আলী রাঃ সম্পর্কে নবী করিম সাঃ বলেছেন, আলী প্রেম মানুষের পাপ এমনভাবে ধ্বংস করে যেমনি আগুন জ্বালানী কাঠ ধ্বংস করে দেয়। একবার হযরত আলীকে দেখে আল্লাহর রাসুল বলেছিলেন, তিনটি এমন বৈশিষ্ট্য তোমার রয়েছে যেটা আমারও নেই, এই তিনটি বৈশিষ্ট হচ্ছে, তুমি এমন একজনকে শ্বশুর হিসেবে পেয়েছে, যা আমি পাইনি, এমন একজনকে তুমি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছে, যে কিনা আমার কন্যা, আর তৃতীয়টি হচ্ছে তুমি হাসান- হোসাইনের মত সন্তানের পিতা যেটা আমার নেই ।
গাদীরে খুম্মের বিষয়টি বিশ্বমুসলিম উম্মাহর জন্য নিঃসন্দেহে পাথেয়। সাইয়্যিদিনা আলী ইবনে আবু তালিব রাঃ গাদীরে খুম্মে রাসূলে কারীম সাঃ কর্তৃক তিনার স্থলাভিষিক্ত এটি ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত। উল্লেখ্য ইমাম আলী রাঃ এর সাথে মু’য়াবিয়ার উটের যুদ্ধ পরবর্তীতে ইমাম হুসাইন রাঃ কে সহপরিবারে মু’য়াবিয়ার পুত্র এজিদ কর্তৃক হত্যা যা ইতিহাসের পর্যালোচনায় পূর্ববর্তী গোত্রীয় নেতৃত্বের ক্ষমতার প্রতিশোধের নির্মম হত্যাযজ্ঞ । যেসকল মুসলিম ভাই ও বোনেরা সাইয়্যিদিনা ইমাম আলী রাঃ কে পাকে পাঞ্জনের অংশ হিসেবে আহলে বাইতের সদস্য মনে করেন এবং এও বলে বেড়ান যে তিনি যুবকদের মধ্যে প্রথম মুসলিম।
তাহলে বিষয়টি একটু ভেবে দেখুন স্ববিরোধী হয়ে গেলো কিনা ? এছাড়াও যারা আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা দেখান এবং পাশাপাশি মু’য়াবিয়া ও এজিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এটাও ঈমান বিধ্বংসের রীতির শামিল নয় কি? বস্তুত রাসূলে কারীম সাঃ এর পার্থিব লোকান্তরের পরবর্তী সময় খলিফা নির্বাচন থেকে শুরু করে কারবালার হত্যাযজ্ঞ পর্যন্ত সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আহলে বাইতের প্রতি অশ্রদ্ধা পূর্বগোত্রীয় প্রভাবের জাগরণ মুসলিম মধ্যে ফেৎনা সৃষ্টির ক্ষেত্র। তাই ইসলামের ইতিহাসের ঐতিহাসিক “গাদীরে খুম্মের গুরুত্ব” আরোপে ইসলামিক জীবন বিধান বাস্তবায়নে আহলে বাইতের প্রেমই মুসলিম উম্মার ঈমানী ঐক্যের একমাত্র পথ ও মত হওয়াটাই সমীচীন।
লেখকঃ
প্রধান সমন্বয়ক,
বাংলাদেশ সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম।