শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও ও পাশের কয়েকটি গ্রামে হিন্দু ধর্মালম্বীদের ওপর হেফাজত অনুসারীদের সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ জানিয়ে গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সোস্যাল অ্যাক্টভিস্ট ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক মুফতী মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী শাল্লায় হিন্দু ধর্মালম্বীদের ওপর হামলায় জড়িতদের দ্রুত দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।
২০ মার্চ ২০২১ শনিবার গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে মুফতী মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী এসব কথা বলেন।
বিবৃতিতে এই নেতা বলেন, ১৫ মার্চ সোমবার সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত সম্মেলনে যান হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। সম্মেলনে মামুনুল হকের দেওয়া বক্তব্যের সমালোচনা করে স্থানীয় এক হিন্দু যুবক ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন বলে জানা যায়। “ওই ঘটনাকে ধর্মীয় উসকানি আখ্যায়িত করে ওই এলাকার মামুনুল হকের অনুসারীরা মঙ্গলবার রাতে বিক্ষোভ মিছিল করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ সেই রাতেই ওই যুবককে আটক করে। বিষয় হলো শাল্লায় ১৭ মার্চ ২০২১ বুধবার সকালেই কাশিপুর, নাচনী ও চণ্ডিপুরসহ কয়েকটি গ্রামের হেফাজত নেতা মামুনুল হকের কয়েক হাজার অনুসারী কথিত হেফাজত ইসলাম সমর্থিত পরিচয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে নোয়াগাও ও পাশের কয়েক গ্রামে হিন্দু ধর্মালম্বাদীর ওপর হামলা চালায়। মানবতাবিরোধী নৃশংস তাণ্ডবের তীব্রতায় হাজার হাজার নিরহ মানুষ জীবন রক্ষায় গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। এমনকি হেফাজত নেতার অনুসারীরা ব্যাপক আকারে বাড়িঘর ভাঙচুর চালায় এবং টাকাপয়সাসহ জিনিসপত্রও লুটপাট করে।
তিনি আরো বলেন,প্রকৃতির অপূর্ব লীলাভূমির জনপদ সম্প্রীতির বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে রয়েছে সম্প্রীতির মরমি ব্যক্তিত্ব হাসন রাজা, শাহ আব্দুর রাজ্জাক কালাশাহ, রাধা রমণ, দুর্বিন শাহ, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম ও বাউল কবি ক্বারি আমির উদ্দিন। বিশেষ করে দিরাইর শাল্লায় রয়েছে প্রগতিশীল রাজনৈতিক বরুণ রায়, গুলজার আহমেদ, অক্ষয়কুমার দাশ, আব্দুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অমর স্মৃতি। তাছাড়াও রয়েছে প্রগতিশীল রাজনৈতিক গুণীজনের মানবিক মূল্যবোধের স্মৃতিজড়িত শতবছরের সম্প্রীতির ইতিহাস। এ হামলার মধ্য দিয়ে কথিত হেফাজত ইসলাম আবারো প্রমাণ করলো তারা সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করেনা। দাঙ্গা-হাঙ্গামা উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবই তাদের মূল কাজ।মানবতাবিরোধী নৃশংস এ যজ্ঞ সংগঠিত করে তারা বাংলাদেশের সম্প্রীতির ইতিহাসের ওপর করেছে কলঙ্ক লেপন।
নাফিয়ী আরো বলেন,আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে ১৭ মার্চ ২০২১ বুধবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জম্মশতবর্ষিকীর উৎসবের দিনে সুনামগঞ্জের দিরাইর শাল্লায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হেফাজত ইসলাম সমর্থকগোষ্ঠী পরিচয়ে কাদের উসকানি ও প্রেরণায় এই আক্রমণ হলো এবং তাদের মূল পরিচয় কী? আমরা কিন্তু শাপলা চত্বরে হেফাজতের দেশ ও সরকারবিরোধী সে ষড়যন্ত্র ও তাণ্ডব কথা ভুলে যায়নি। তাই এদেরকে আর ছাড় নয়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে এ হামলার রহস্য কী তা দ্রুত বের করে অপরাধীদেরকে আইনের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে করে তারা ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িক বীজ রোপন করতে না পারে।
মুফতী মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী বলেন উল্লেখ্য যে, ওয়াজ মাহফিলে বরাবরই হেফাজত নেতারা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাবুনগরী ও মামুনুল হকের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য। সেই মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লিখেছিল এক হিন্দু যুবক। হেফাজতের অনুসারীরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। হামলার আগের রাতে আপত্তিকর লেখার অভিযোগে যুবককে সোপর্দ করা হয় পুলিশের কাছে। তবুও, ১৭ মার্চ বুধবার সকালে দিরাই-শাল্লা উপজেলার নাচনী, চণ্ডিপুর, সন্তোষপুর, কাশিপুর, সরমঙ্গলসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে কয়েক হাজার হেফাজত অনুসারীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সংঘবদ্ধভাবে শাল্লার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম নোয়াগাঁওয়ে হামলা চালায়। এসময় তারা ঘরবাড়ি ভাঙচুর, ব্যাপক লুটপাট করে। এতে নিরীহ ও ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও যুবককে মারধরের অভিযোগও উঠেছে। এমন দৃশ্য ১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর একাত্তরে পাকিস্তানী হায়নাদের তাণ্ডবের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন,পরিতাপের বিষয় হলো হেফাজতের নেতারা প্রতিনিয়ত সারাদেশে মাহফিলের দ্বারায় তাদের রাজনৈতিক এজেণ্ডা সহজ-সরল শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যে দিনের পর দিন উসকানির মাধ্যমে বুঝিয়ে উত্তেজিত করছে। পাশাপাশি প্রগতিশীল লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতি কর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ সরকারের বিরুদ্ধেও। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানের মূল নীতির বিষয়েও তাদের পরিকল্পিত প্রশিক্ষিত বক্তৃতার কারণে সাধারণ জনমনে নিয়মিত ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। যারা সুনামগঞ্জের শত বছরের সম্প্রীতির সুনাম নষ্ট করেছে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিও দেখে দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক। যাতে ভবিষ্যতে কখনো কেউ এমন আক্রমণের দুঃসাহস না দেখায়। রামু, রংপুর, নাসিরনগর, ভোলা ও শাল্লার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এই ঘটনাগুলো একই সূত্রেগাঁতা। আমাদের মনে রাখতে হবে এই দেশ অসম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ। “ধর্ম যার যার প্রিয় বাংলাদেশ সবার।” এই দেশে ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপন করা চলবেনা। বাংলাদেশে দেশে সকল ধর্ম বিশ্বাসী নাগরিকের অধিকার সমান। আমাদের মহান সংবিধানেও সকল ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের সমাধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সুতারং আর কালক্ষেপণ নয়, দেশের শান্তি, সম্প্রীতি, স্থিতিশীল পরিবেশ ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রার স্বার্থে এইসমস্ত উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক বক্তাদের ওয়াজের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিৎ।